শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০১ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
কুষ্টিয়া ছিল মূলত একটি থানা যা ১৮২৮ সালে পাবনা জেলার অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৮৬২ সালে কুষ্টিয়া মহকুমার কাজ আরম্ভ হলেও কুষ্টিয়া মহকুমা নদীয়া জেলাভূক্ত হয় ১৮৬৩ সালে। নীল হাঙ্গামা জনিত কারনে বিচারের জন্য কুমারখালীর ভালুকায় একটি মুনসেফী আদালত প্রতিষ্ঠা হয়। ঈষান চন্দ্র দত্ত প্রথম মুনসেফ হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। তিনি ছিলেন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সার্থক গ্রন্থকারিক সি আর দত্তের পিতা। ১৮৬৩ সালে কুষ্টিয়া থানা ও কুমারখালী থানা পাবনা জেলার অর্ন্তভূক্ত হলে ভালুকা থেকে মুনসেফ আদালত উঠে যায়।
১৮৬৩ সালে কুষ্টিয়া মহকুমার মর্যাদা পেলে কুষ্টিয়ায় মুনসেফী আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। কুষ্টিয়া প্রথমে রাজশাহী জেলা জাজশীপের অধীনে ও পরে পাবনা জেলা জাজশীপের অধীনে থাকে। কুষ্টিয়াতে পৃথক জেলা জজ নিয়োগের আগ পর্যন্ত পাবনা জেলা জজ সাহেব মাসে ১৫ দিন কুষ্টিয়া বসে বিচার কাজ করতেন।
উল্লেখ্য,নদিয়া একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল। ১৭৮৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকালে জেলা হিসেবে নদিয়ার আত্মপ্রকাশ। সে সময় বর্তমান হুগলি ও উত্তর ২৪ পরগনা জেলার কিছু অংশ এই জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট সাময়িকভাবে এই জেলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। তিন দিন বাদে ১৮ আগস্ট কিয়দংশ বাদে নদিয়া পূনরায় ভারত অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রয়ারি নদিয়া জেলা তার বর্তমান রূপটি লাভ করে। ১৯৪৭ সালে সাময়িকভাবে জেলার নামকরণ নবদ্বীপ করা হলেও অনতিবিলম্বেই সেই নামকরণ বাতিল হয়।
বর্তমান জেলা জজ সাহেবের বাসভবন, যা পুলিশ লইনের পার্শ্বে অবস্থিত সেখানে জেলা জজের এজলাস বসত। কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ বিল্ডিং এ মুনসেফ কোর্ট বসত। এরপর ১৯৬৮ সালের ১৭ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার জন্য পৃথক জেলা জজ কোর্ট নির্মাণ ও কার্যক্রম শুরু হয়। যা বর্তমান পর্যন্ত রয়েছে।
এরপর ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর ১৯৪৭ সালে আইনজীবী সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় কুষ্টিয়া মহকুমায়। কুষ্টিয়া বার সভায় উপস্থিত সভ্যগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শ্রী যুক্ত বাবু বিনয়কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, শ্রী যুক্ত বাবু বিনয় নাথ বাগচী এরা দুজনই আইনজীবী সমিতি প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ও সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন। মুসলিম আইনজীবীদের মধ্যে সর্বপ্রথম মোঃ কুতুব উদ্দিন আহমেদ ১৯৫০ সালে আইনজীবী সমিতির সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন।
আইনজীবী সমিতিটি প্রতিষ্ঠার পর হতে কুষ্টিয়াতে নানা কল্যাণকর কাজ করেছে। ৫২’এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪’ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬’ এর ছয় দফা দাবী, ৭০’ এর সাধারণ নির্বাচন ও ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে আইনজীবী সমিতির ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।
ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পূর্বে এখানকার আইনজীবীগণ ফৌজদারী আদালতে যেতেন না কিংবা ফৌজদারী মামলা পরিচালনা করতেন না। তাদের কার্যক্রম কেবলমাত্র দেওয়ানী আদালতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট বৃটিশ আইন সভা ভারত ও পাকিস্তানকে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ এর বলে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। এ আইন অনুসারে, স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানের জন্য নতুন সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত এ দুই দেশের সরকার পরিচালিত হবে ভারত সরকার আইন, ১৯৩৫ এর মাধ্যমে। বিচার বিভাগের গঠন প্রণালি ১৯৪৭ সনের আগে যেরূপ ছিল প্রধানত তাই রয়ে গিয়েছে। ১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইন সরকারের গঠন পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে দেয়। ফলে শাসন ব্যবস্থা একক বা কেন্দ্রীয় শাসন পদ্ধতি হতে ফেডারেল পদ্ধতিতে পরিবর্তিত হয়। এ আইনের বিধি অনুসারে ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশেই নতুন সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত ফেডারেল আদালত চালু রাখা হয়। পাকিস্তান গণপরিষদ ‘প্রিভি কাউন্সিল (অধিক্ষেত্র বাতিল) আইন, ১৯৫০’ পাশ করে যা পাকিস্তানের ফেডারেল আদালত হতে প্রিভি কাউন্সিলে আপীল দায়েরের ব্যবস্থাকে বাতিল করেছিল। পাকিস্তানের এ সংবিধান ১৯৫৮ সালে বাতিল করা হয়েছিল এবং ১৯৬২ সালে নতুন আরেকটি সংবিধান চালু করা হয়, কিন্তু সমগ্র বিচার কাঠামো একই রয়ে যায়।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে ও কুষ্টিয়া জজ কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮